আমার শহর

"মেঘের চাদরে মোড়া চেনা শহর,
সবুজের গন্ধের মোড়কে ভরে থাকে
ভালোবাসার আঙ্গিনা।"
ঠিক এইভাবেই শহরটার প্রেমে পড়েছিলাম। বয়স তখন সবে তেরো, মা বাবার হাত ধরে এই স্বপ্নের দেশে পাড়ি দি। মনের মধ্যে ছিল অনেকটাই কৌতূহল আর কিছুটা ভয়। কিন্তু কখন যে এই ভয়টা কাটিয়ে এই শহরটাকে ভালবেসে ফেলেছিলাম তা বুঝতে পারিনি।
ওহ! শহরটার নামটা তো বলাই হল না! আমার কালিম্পং।

স্কুল জীবনের বেশির ভাগ সময়টাই আমার এখানে কাটানো। স্কুলের নাম ছিল নেপালি গার্লস হাই স্কুল। এই শহরের মধ্যমণি ছিল আমার স্কুল। পাহারের কোলে থাকায় স্কুলটি এই শহরটির মতোই ছিল সৌন্দর্যে ভরপুর। স্কুলটির পাশেই ছিল হোস্টেল ক্যাম্পাস। ওখানেই আমাকে থাকতে হত। বেশ কয়েকজন নতুন কিছু ছোট -বড় মানুষের সাথে আলাপ হয় সেখানে। শহরটার মতন ওখানকার মানষগুলো বেশ সুন্দর। ভীষণ জলদি আপন করে নেয় সবাইকে তারা। দেখতে গেলে বেশ ছোট বয়স থেকেই হোস্টেল জীবন সম্পর্কে ধারণা এসে গিয়েছিল। দিনগুলো বেশ মজায় কাটতো। সকালে স্কুল আর বিকেলে হোস্টেল এ গিয়ে সোজা খেলতে চলে যাওয়া, এইভাবেই সারাটা দিন কেটে যেতো। আর রবিবার দিনগুলো ক্যাম্পাস থেকে একটু বেরিয়ে পাশের চার্চে নিয়ে যাওয়া হতো।

শুধু তাই নয়, বিশেষ দিন যেমন রবীন্দ্রজয়ন্তী, ১৫ই আগস্ট এই দিনগুলিতে আবার স্কুলে বেশ বড় করে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। অনেকবার সেখানে অংশগ্রহন করেছিলাম।

কিন্তু সব কিছু থাকা সত্ত্বেও ভাল লাগতো না। কারণ গোটা শহরটা ঘুরে দেখার খুব ইচ্ছে হতো। যদিও পরে সে সুযোগটা পেয়ে যাই। হোস্টেল ছেড়ে অন্য জায়গায় থাকতে শুরু করার সাথে সাথে জায়গাটাকে জানতে শুরু করি। শহরটার প্রতি এক  অদ্ভুত ভালোলাগা- ভালোলাগা ঠিক না, ভালোবাসা জন্মাতে শুরু করে। নিজেকে নতুন করে পেতে শুরু করি। সকালে উঠে বারান্দা থেকে বরফে ঢাকা কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখে যেন নিজের মধ্যে প্রাণ ফিরে পেতাম। কখনও মনে হতো না যে আমি অন্য একটা শহরে থাকি। মনে হতো এই শহরটাই আমার নিজের। ঘুরতে যাওয়ার জায়গা বলতে থাকতো ডেলো, তিরপাই, দুরপিন ডারা। মাঝে মাঝে তো বাড়ির ছাদটাই যথেষ্ট ছিল ঘোরার জন্য। আর মন খারাপ হলে চলে যেতাম কোন খোলা জায়গার হাওয়া খেতে।


সবচেয়ে বেশি ভালো লাগতো ঠিক সন্ধে নামার সময়। কি সুন্দর পাহাড়ের গায়ে থাকা বাড়িগুলোতে এক এক করে আলো জ্বলে উঠত। একবারের জন্যও মনে হতো না যে বাড়ি থেকে অনেকটাই দূরে আছি বলে। ওটাই তো আমার বাড়ি!


মনে আছে যখনই পড়তে বসার সময় হতো, সকাল সকাল ছাদে চলে যেতাম বই খাতা নিয়ে। সাথে দুই কি তিনজন বন্ধুও থাকতো। প্রকৃতির সৌন্দর্যের সাথে পড়তে বসার মজাটাই ছিল আলাদা। এ নিয়ে অনেক বকাও শুনতে হতো আন্টির কাছ থেকে।

এভাবেই যে কিভাবে পাঁচটা বছর কেটে গিয়েছিলো কখনও বুঝতেই পারিনি। যেদিন মা বাবার সাথে ওই জায়গাটা ছেড়ে কলকাতায় আসি খুব কেঁদেছিলাম। মনে হয়েছিল যেন খুব কাছের কিছু ছেড়ে আসছি। মাকে বার বার বলেছিলাম, "আমি ঠিক ওখানে আবার ফিরে যাবো।" দেখতে দেখতে প্রায় চার বছরও কেটে গেছে কলকাতাতে আছি। কিন্তু তাও যেন এই শহরটাকে আপন করে নিতে পারি না। মন খারাপ হলে ইচ্ছে হয়, "ইশ! যদি খোলাতে যেতে পারতাম।" মনে হয় নিজেকে যেন ওখানেই কোথাও রেখে এসেছি। চোখ বন্ধ করলেই যেন সামনে খোলা আকাশ, তিস্তা নদী আর চারিদিকের পাহাড়গুলো ভেসে ওঠে। কালিম্পং শহরটাকে কিভাবে যে এতটা ভালোবেসে ফেলেছি নিজেও জানিনা। তাই সব শেষে একটাই কথা বলে ওই শহরটার প্রতি নিজের ভালোবাসা সবটুকু বোঝাতে চাই -

" মনলাই সছো রাখি হিড়ি রহেছু
মো তিমরও সাহারমা বাঁচি রহেছু মায়ালু।"
হ্যা মনটাকে শান্ত রেখে ওই শহরের জন্যই বেঁচে থাকি।

Comments

Popular posts from this blog

রঙ-তুলির আত্মকথা

আমার একটা তুমি চাই